নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকেই রাষ্টের সাংবিধানিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করার অধিকার রাখে। এটি কারও দয়া বা আন্তরিকতার বিষয় নয়। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের আবাসস্থল। গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেব বাংলাদেশের যথেষ্ট সুনাম থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে ১৮ দলের, বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের হরতাল-অবরোধে যে ধ্বংসাত্মক ঘটনাগুলো ঘটেছে তা দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেই শুধু নয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও এর নেতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। বিশ্বের প্রায় সব ক্ষমতাধর দেশ জামায়াত-শিবিরের ধ্বংসাত্মক জ্বালাও-পোড়াও নীতিকে অনৈতিক বলে আখ্যা দেওয়ার পাশাপাশি দলটির রাজনীতি করার বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়।
এ ধরনের ঘটনার পূনরাবৃত্তি বা ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে এদেশ ও জাতিকে বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে এবং বাংলাদেশ সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তালিকায় চলে যাবে। পবিত্র ধর্ম ইসলামে ধংসাত্মক বা হিংস্রতা গ্রহনযোগ্য নয়। হত্যা তো দুরের কথা, মানুষের মনে কষ্ট হোক-এমন ব্যবহার করাও নিষেধ রয়েছে। সুরা আল বাকারার ১৭৮ নং আয়াতে কোন মানুষ সেচ্ছায়, সজ্ঞানে, ইচ্ছাকৃতভাবে, অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করলে বিনিময়ে হত্যা করার বিধান রয়েছে। ইসলামের পরিভাষায় যাকে বলা হয় “কেসাস”। একই সুরার ২১৭ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে, হত্যার আদেশ দাতার শাস্তি ওই হত্যাকারীর চেয়েও কঠিন। গত ২০১৩ সালের শেষের দিকে এবং এ বছরের জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে হরতাল ও অবরোধকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগুলো ঘটে গেল, তা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। প্রাণীকুলের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সুখ-শান্তিতে বসবাসের নিমিত্তে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন বিশ্বব্রহ্মান্ড। আলো-বাতাস-পানিসহ কয়েকটি অতি প্রয়োজনীয় বস্তু রেখেছেন সবার জন্য উন্মুক্ত। চলাচল ও বসবাসের জন্য জল ও স্থল ভূমি রেখেছেন সবার জন্য অবারিত।
সব শ্রেনী, পেশা ও বর্ণের মানুষ বিশ্বের যে কোন দেশেই শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে- এটিই প্রকৃত বিধান। সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বলে সমাজে শ্রেনীবিন্যাস করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে দুরত্ব ইসলাম ধর্মসহ যেকোন মতাদর্শেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্বে প্রায় ২০০ টির অধিক ছোট বড় দেশ রয়েছে। এর মধ্যে জাতিসংঘের অন্তর্ভূক্ত মোট দেশের সংখ্যা ১৯৫টি, যার মধ্যে স্বাধীন দেশের সংখ্যা ১৯৩ টি। তা ছাড়া বেশ কয়েকটি দেশ আজও স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি। সব দেশেই রয়েছে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাভাষী মানুষের জন্য আবাসস্থল। বিশ্বের সকল দেশেই বিভিন্ন আনুপাতিক হারে এ সব শ্রেনীর মানুষ বাস করে যাচ্ছে। কম-বেশী সবাই তার বাস্তভিটায় বাস করে জীবনের শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করে আত্মতৃপ্তি পায়। সবাই বিভিন্ন পেশায় কাজ কর্ম করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে। বিদেশে গিয়েও পুনরায় নিজ দেশে ফিরে এসে শান্তির সাথে ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন নিয়েই জীবন সচল রাখতে নিজ নিজ কাজে মনোনিবেশ করে থাকে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই একটি ধর্মের মানুষ সংখ্যাগুরু, বাকী সবাই সংখ্যালঘু।
বাংলাদেশে যিনি সংখ্যালঘু অন্য দেশে একই শ্রেনীটি সংখ্যাগুরু। সুতরাং এ ধরণের ভাবার অবকাশ নেই। দৃশ্যমান বা অদৃশ্য সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টি, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রধানত মানুষের উপকারের জন্য বা মঙ্গলের জন্য। তাই জন্মগত সুত্রেই হোক আর গ্রীন কার্ডের মাধ্যমেই হোক রাষ্ট্র বা দেশ সবার। মানুষ হিসেবে সকলেরই যার যার অবস্থান থেকে সাধ্যানুযায়ী স্বাধীনভাবে বসবাস করার অধিকার রয়েছে। কেহ যেন অধিকার বঞ্চিত না হয়। ৫ ই জানুয়ারী নির্বাচনপূর্ব ও উত্তর সময়ে বাংলাদেশের ধংসাত্মক ঘটনাগুলি শুধু বিবেকবান এ দেশের মানুষই নয়, বিদেশী বন্ধুরাও শংকিত। বিদেশে অবস্থানরত অনেক বাংলাদেশিও সন্দেহের চোখে রয়েছেন বিদেশীদের কাছে। হরতাল অবরোধে হিংসাত্মক ঘটনাবলী দ্বারা মানুষ হত্যা, কল-কারখানা, যানবহন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বইপত্রসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ঘটনায় সম্পদের ক্ষতির পরিমান হাজার হাজার কোটি টাকা। সহিংসতায় যথাক্রমে ৪৭৫ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৮৭ টি উচ্চ মাধ্যমিক, ২৬টি মাদ্রাসা ও ১২টি কলেজে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। তা ছাড়া রয়েছে ব্যাংক-অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনা। আরও রয়েছে বাসতবাড়ী, গাড়ী, মিল-কারখানা, ট্রেন ও লঞ্চসহ অনেক কিছু। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মন্দির। আর্থিক ক্ষতির পরিমান যাই হোক না কেন, বড় ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার্থী ও স্বজনহারা পরিবারগুলোর।
গত এক বছরে এক হাজার বাস, মিনিবাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে আগ্নিসংযোগ করা হয়। সে হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারী পর্যন্ত এর সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। তা ছাড়া বাস-ট্রাক ভাংচুর করা হয়েছে প্রায় তিন হাজার ৫০০ টি যার ক্ষতির পরিমান প্রায় ১৩০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির তথ্যমতে, অগ্নিসংযোগ ও বোমা বাজিতে ৫৫ জন পরিবহন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। পরিবহন খাতে ক্ষতির পরিমান প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এক দিনের হরতালে কৃষকের পণ্য বাজারজাতে বাধাগ্রস্থ্য হওয়ায় লোকশানের পরিমান ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা এক হাজার ৯০০ কোটি টাকা। সে হিসাব অনুযায়ী জানুয়ারী ২০১৩ হতে জানুয়ারী ২০১৪ পর্যন্ত এক বছরে ৭২ দিন হরতাল-অবরোধে কৃষকের লোকশানের পরিমান এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। সিলেট প্রবাসী সমিতির এক আলোচনা সভায় উল্লেখ করা হয়, গত ৪২ দিনের হরতাল ও অবরোধে একমাত্র সিলেট জেলায় পাথর, কয়লা ও চুনাপাথর আমদানীতে সরকার রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এমনিভাবে হোটেল ব্যবসায় ক্ষতির পরিমান ২০০ কোটি টাকা, গাড়ী ভাংচুর হয়েছে ২২৫ টি, যার আনুমানিক মুল্য প্রায় ৩৮ কোটি টাকা। গাছ কর্তন প্রায় ৫৫ হাজারটি যার অনুমানিক মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। দেশ ও সমাজের উন্নয়নে প্রয়োজন দল-মত ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভূলে হিংসাবিদ্বেশ, হানাহানির রাজনীতি পরিহার করে দল-মত নির্বিশেষে সবাই মিলে বর্তমান উন্নয়নের গতিকে আরও শক্তির সঞ্চার করতে হবে। সেক্ষেত্রে সব দল-মত, ধর্ম ও বর্ণের বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে হবে একটি সন্ত্রাসমূক্ত, হিংসাত্মক- হরতাল আবরোধমুক্ত বাংলাদেশ।
কালেরকন্ঠে ২০১৪ সালে প্রকাশিত
লেখক
প্রফেসর ডাঃ মোঃ ফজলুল হক
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ওপ্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
দিনাজপুর।